আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমাদের সময়কেও ছাড়িয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন । শিল্প,সংস্কৃতি,অর্থনীতি সকলদিক থেকেই প্রতিনিয়ত আধুনিক আর উন্নত হচ্ছি তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এই উন্নয়নের প্রতিক্রিয়া গুলো আমাদের মানব সমাজে কতটুকু ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা ভাববার বিষয়।
উন্নয়নের আধুনিকতার খোলসে কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের সমাজের মানুষ। একটা গল্প বলি-যা অজানা সকলেরই। তবে উপলব্ধির কাঠগোড়ায় হয়ত উপলব্ধি করে এক মুষ্ঠিবদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন সকলেই।
ফাতেমা নামের মেয়েটির গল্প-যার অর্ক নামের এক ব্যাংকারের চাকুরীজীবীর সাথে বিয়ে হয়েছিল। দুজনের বোঝাপড়া আর ভালবাসায় সংসার জীবন ভালই কেটে যাচ্ছে।
বিয়ের দুই বছরের মাথায় ঘর আলো করে আসে নতুন অতিথী আরিয়ান। আরিয়ানের বয়স তখন সাত বছরের মত। মা আর ছেলে সারাদিন বাসায় ,আর বাবা অর্ক অফিসে। ফাতেমা টিভির পোকা।
এই চ্যানেল থেকে ঐ চ্যানেল একটার পর একটা বহমানতা যেন থামবার নয়। হঠাৎ একদিন সেই ঘটনা ,ফতেমার দুপুরের দিকে চোখটা লেগে এসেছে। এমন সময় আরিয়ান তার মায়ের মুখে চুমু খাচ্ছে,এমনকি ঠোটে পর্যন্ত।
ফাতেমা টের পেল আরিয়ান তার পেটে কামড় দিচ্ছে আর চুমু খাচ্ছে। ফাতেমা আতকে ওঠে, কি কর আরিয়ান? আরিয়ান হেসে বলে আদর করি। এ কথা বলতে বলতেই টিভির দিকে চোখ পড়ে ফাতেমার। হিন্দি গানে যা চলছে আরিয়ান তার মায়ের সাথে তাই!! বলতে লজ্জা লাগছে এমন নিষ্ঠুর সত্যটা আমাকে শুনতে হয়েছিল ফাতেমার কাছ থেকে । টিউশনীর মজার গল্প আর আমার কাছে হয়ত আর গল্প থাকলো না।
ফাতেমা দৌড়ে গিয়ে টিভিটা ভেঙ্গে ফেলে তারপর সারা দিন কান্ন্কাটি করে। সন্ধ্যায় অর্ক বাসায় এসে দেখে সব লন্ডভন্ড।কি হয়েছে ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করলে সে শুধু কাঁদে কথা বলতে পারে না।
এরপর অর্ক যতবার শারীরিক ভাবে মিলিত হতে চেয়েছে , ফাতেমা নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। এতে করে কিছু একটা সমস্যা যে চলছে তা বুঝতে বাকী নেই অর্কের। কিছুদিন এভাবে চলার পর অর্ক ফাতেমাকে নিয়ে মানসিক ডাক্তারের কাছে যায়। ফাতেমা শুধু বলে তার কিছু হয় নি।
ডাক্তার অর্ককে রুম থেকে বের করে দিয়ে ফাতেমার সাথে একা কথা বলে। না-তেমন কোন কথা বের করা যায়নি ফাতেমার কাছ থেকে। একপর্যায়ে ফাতেমা রাগারাগি শুরু করে এবং সেই সাথে কান্নাকাটি। ডাক্তার কিছু ঔষধ দেয় আর অর্ককে বলে সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে ,দুিশ্চন্তা করো না।
কোন বিষয়ে মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছে,কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। আর হে তুমি এসব নিয়ে ফাতেমাকে কিছু জিজ্ঞেস করোনা। তুমি স্বাভাবিক আচরন করলেই ও দ্রুত সেরে উঠবে। এরপর ডাক্তারের কথাই সত্য হল।
আরিয়ান ক্লাস সেভেনে পড়ে এখন। তবে আর কোন বাচ্চা কেন হয়নি তা আমার কাছে রহস্য। আমি আরিয়ানের হাউজ টিউটর । ফাতেমা ভাবীর সাথে আমার খুব ভাল একটা বন্ধুত্ব। উনি উনার পরিবারের কথা,বান্ধীদের কথা,আরও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতেন আমার সাথে।
আমিও বেশ মজা পেতাম উনার সাথে কথা বলে। একদিন বললাম ভাবী আপনার বাসায় টেলিভিশন নেই,ব্যাপারটা অদ্ভুত। তিনি রেগে গেলেন,আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ কি হলো।
তারপর তিনি অঝড় ধারায় কান্না করছেন। ভাবী আমি দুঃখিত, আমিতো বুঝতে পারছিনা আপনি কেন কান্না করছেন।
কান্নার কারন অনেক হতে পারে- দুঃখে মানুষ কাঁদে,আনন্দে কাঁদে,ভয়ে কাঁদে।আপনি কেন কান্না করছেন তা তো বুঝতে পারছিনা,আমার কথায় কষ্ট পেলে আমি সরি। ভাবী প্লিজ কান্না করবেন না। তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ।
হঠাৎ তিনি আরিয়ানের ঘটনাটি বললেন। আমি হতবাক হয়ে গেলাম কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম,এটা কোন ব্যাপার না ওতো না বুঝে এমন করেছে। হুম বলে মাথা ঝাকালেন আর বললেন কাওকে বলোনা কিন্তু তুমি।
আমার বুক থেকে মনে হচ্ছে একটা পাথর সরে গেছে। অনেক হালকা লাগছে। ভাবীর চেহারায় সংকোচ,ভয়,সস্তীর এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া ভেসে উঠলো ।
এ প্রতিক্রিয়ার অর্থ বোধগম্য হয়নি আমার ,তবুও না বুঝে বিস্মিত হয়েছি। সে দিন আমি চলে এসেছিলাম। আমি ভাবছিলাম আমাদের ফিল্মের উন্নতির কথা। ভাবছি ভালবাসা বোঝানোর জন্য কি নায়ক-নায়িকাদের বিছানার দৃশ্যই দেখাতে হবে?
এই দৃশ্য গুলো দেখিয়ে আসলে কি বোঝাতে চায় ফিল্ম ম্যাকাররা। আর আমরা যারা অত্যাধুনিক সময়ের ছেলে মেয়েরা তারাই কি শিক্ষা পাচ্ছি এসব দেখে! ফাতেমা ভাবী আর টিভি দেখেনি,অথচ যে কি না এক মুহুর্ত টিভি ছাড়া থাকতে পারতো না।
আমাদের অনেকের জীবনেই হয়ত এরকম নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে।
একবার নিজের স্মৃতির সাথে কথা বলুন ঠিক হয়ত পেয়ে যাবেন। আমরা এখন অনেক বেশী অপেনআপ আর ফ্রেন্ডলি হতে শিখছি।
অপেন হওয়ার মানে কি মানুষের গোপনীয়তাগুলোকে টিভি স্ক্রিন এ তুলে ধরা ? অনায়াসেই মুভি গুলোতে নর-নারীর দৈহিক প্রেমের অনুভূতি আর অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়। এগুলো কতটা উপকার করছে আমাদের ?
সেলিব্রেটিদের ফ্যাশন আমাদের ফ্যাশন হয়ে উঠবে বিশ্বকাপে বিভিন্ন প্লেয়ারের চুলের স্টাইল দেখে আমাদের দেশের অনেক ছেলে সেইরকম করে চুল কেটেছে। মাথার দুই পাশে একদম ছোট ছোট মাঝখানে বড় করে চুলের স্টাইল।
এর আগে আমির খানের (বলিউডের নায়ক) গজ্নী স্টাইল। আবার এখন অনেক মেয়েরাই প্যান্ট আর টিশার্ট পরিধান করে নিজেদের স্বাধীনচেতা বলে দাবী করছে।
টিশার্ট আর প্যান্ট পড়ে যদি স্বাধীনতা আর মান-মর্যদা বৃদ্ধি করা যেত তাহলে হয়ত আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রি আর শাড়ী পড়তেন না । এসব পোশাকতো আমাদের ৃসংস্কৃতি বা ঐতিহ্যে নেই। তাহলে আসলো কোথথেকে এসব।
আসলে এগুলোর পেছনেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের মিডিয়ারই অবদান। বহির্বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে চলা মানে নিজেদের সংস্কৃতির রুপরেখার পরিবর্তন নয় নিশ্চয়? আমরা যেসব মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের প্রভাব নিজেদের গায়ে ভর করাই ,তাদের সমাজ-বাস্তবতা আর আমাদের বাস্তবতা এক নয় ।
প্রাচীনকালে মানুষ অসভ্য ছিল।লজ্জা নিবারন করতোনা,তাই পোশাক পরিধান করে সভ্য হল। আমি সংকিত যে ,জ্ঞান-বিজ্ঞান,প্রযুক্তি,সভ্যতার অগ্রগতিতে হয়ত মানুষ আবার কাপড় ছাড়া থাকবে “আগের মানুষ না বুঝে উলঙ্গ থাকতো,এখন মানুষ বুঝে শুনে উলঙ্গ হচ্ছে” কাপড়-চোপড়গুলো দিনদিন ছোট হয়ে আসছে,
জানিনা এগুলো আর কতটা ছোট হলে “আমরা সভ্য” এই কথাটা বলা আমাদের অনধিকার চর্চা হবে। ফাতেমা ভাবীর অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে আমাদের সমাজের নানা বিষয় মনে ভেসে উঠছিল। নানা আতঙ্কের মাঝে একটি প্রশ্নই উদয় হলো মনে – “কোন দিকে যাচ্ছি আমরা”???
টিউশনীর মজার গল্প থেকে কি কিছু পেলাম আমরা? আমি পেয়েছিলাম তাই আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
2 মন্তব্যসমূহ
সুন্দর লেখা
উত্তরমুছুনএকটা ঘটনা দিয়ে কিভাবে আমাদের সমাজকে তুলে ধরলেন। খুবই ভাল লিখা। আর হে এটা সসত্যিই আমরা যে কোন দিকে যাচ্ছি। আল্লাহই ভাল জানেন।
উত্তরমুছুনplease don't enter any spam links in the Comment Box.