মাটি দিয়ে আপেল ও কলা তৈরীর উপায়

কিভাবে মাটি দিয়ে আপেল, কলা তৈরী করা যায় তা জানার আগে আমাদের উচিৎ এই শিল্প মাধ্যমটিকে নিয়ে কিছু কথা বলা। হ্যা, মৃৎশিল্প আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ধারা। কাদামাটি শিল্প পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প। মহাস্থানগড় ,পাহাড়পুর, ময়নামতি সহ দেশের নানা জায়গায় পুরাকীর্তিগুলো দেখে বুঝা যায় , এই ভূখণ্ডে উন্নত মানের মৃৎশিল্প ছিল সুদূর অতীতে।


মাটি দিয়ে আপেল ও কলা তৈরীর উপায়



এই শিল্পের চর্চা চলছে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে। যুগ যুগ ধরে কুমোররা মাটি দিয়ে বিভিন্ন রকম জিনিস তৈরি করে আসছে । এখনো তাদের নিপুন হাতে গড়ে চলেছেন মাটির বাসন-কোসন ,সরা -সুরাই, কলসি, ফুল, ফল, হাড়ি ,পাতিল, পেয়ালা, মটকা, পিঠা তৈরির ছাঁচ ইত্যাদি তৈজসপত্র । সুদূর অতীত  থেকে সেই শিল্পকে সযত্নে লালন করে চলেছেন আমাদের কুমোররা।

 

মাটির তৈরি হরেক রকম শখের জিনিস বাজারে বিক্রি করা হয় । আমরা সেসব শখের জিনিস কিনে ঘর সাজিয়ে থাকি সেইসব জিনিস কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই  নিজেরাই তৈরী করতে পারি । এতে তেমনকোন টাকাই খরচ হয় না। বরং কিনে আনতে যে টাকাটা খরচ হতো সেটা সাশ্রয় হয় । আর নিজের জিনিস নিজে তৈরীর যে আনন্দ তাতো বোনাস হিসেবেই থাকবে। তাই আজ এমনই একটা কাজ শিখতে চলেছি যা তৈরী করে যেমন পয়সা বাঁচবে তার চেয়েও বেশী মিলবে আত্মতৃপ্তী। তাই চলুন আজকে আমরা শিখব কিভাবে মাটি দিয়ে আপেল কলা বানাতে হয়।

 

 মাটি দিয়ে আপেল, কলা তৈরীর উপকরণ:

 ১. কাদামাটি

 ২.আমের  বোঁটা

 ৩.এক্রেলিক রং (সাদা, লাল, হলুদ, খয়রি, সবুজ, কালো)

 

উপকরণের দাম এবং কোথা হতে পাওয়া যাবে উপকরণ:

1.    কাদামাটি: নদ-নদী, হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, খাল, পুকুর এর পাড় হতে এই মাটি খুব সহজেই সংগ্রহ করা যাবে । এতে সাধারণত টাকা খরচ করতে হবে না।

 

 ২. আম গাছের পাতার বোঁটা: আমাদের দেশে আম গাছ সচরাচর সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। আম গাছের পাতায় যে বোটা বিদ্যমান এখানে এসেই বোঁটা ব্যবহার করা হয়েছে।

 

 ৩.এক্রেলিক রং: যে কোনো ভালো মানের স্টেশনারি দোকান হতে এই রং পাওয়া যাবে। প্রতি ১৫ ml এক্রেলিক রঙের কৌটার দাম ৩৫ টাকা। আপেল  ও কলা রং করতে ১৫ ml এর খুব সামান্য পরিমাণ প্রয়োজন পড়বে।

   বি:দ্র: আমরা কতটুকু আকারের এবং কয়টা করে কলা  ও আপেল বানাবো তার উপর উপকরণের পরিমাণ নির্ভর করে।

  

 মাটি দিয়ে আপেল, কলার প্রস্তুত প্রণালীঃ

 

 ক. মাটি  প্রস্তুত: মাটিকে কিছু সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর মাটির দলা ভেঙে মসৃণ করতে হবে।

পড়ুন

 


 খ.আপেল ও কলা বানানো:

     আপেল : আপেল বানানোর জন্য প্রস্তুত   মাটির  মন্ডটিকে গোলাকার আকার দিতে হবে । দুইহাতে নিচের দিকে কিছুটা চেপে দিতে হবে। অর্থাৎ উপরের দিক তুলনামূলক একটু মোটা এবং নিচের দিকে চাপা । এরপর যে কাজটি করতে হবে সেটি হচ্ছে আপেলের উপরের দিকে মাঝখানে কিছুটা গর্তের মতো কর তে হবে । এর নিজের দিকেও একটু গর্ত করতে হবে ।আপেলের উপরের অংশের মাঝখানে ঠিক যেখানে কিছুটা গর্ত করা হয়েছে সেখানে আমের বোঁটাটি বসাতে হবে । তৈরি হয়ে গেল মাটির আপেল।

     কলা : কলা কতটুকু বড় বা ছোট হবে সেই অনুপাতে মাটি নিতে হবে ।তারপর মাটির মন্ডটিকে লম্বালম্বিভাবে একটি  শেইপ দিতে হবে ।এখন হাত দিয়ে লম্বাকৃতির মণ্ডটির দুই প্রান্ত একই দিকে  বাঁকাতে হবে ।এবার অনেকটাই দেখতে কলার মত হবে ।এরপর এটিকে আলতোভাবে হাত দিয়ে চেপে চেপে কলাটির নিচে বোঁটা বানাতে হবে। আর এভাবেই তৈরি করতে হবে মাটির কলা।

    

গ.রোদে শুকানো : এবার মাটির তৈরি আপেল ও কলা কে কড়া রোদে দুই-তিনদিন শুকাতে হবে। মাটির তৈরি করা ও আপেল যখন পুরোপুরিভাবে শুকিয়ে যাবে তখন সেটি রং করার জন্য প্রস্তুত।

 

মাটি দিয়ে আপেল ও মাটি তৈরীর উপায়

 ঘ.রং করা:

    আপেল :আপেলটি রং করতে প্রয়োজন হবে এক্রেলিক সাদা, লাল, হলুদ  ও খয়রি রং ।প্রথমে আপেল টিতে অ্যাক্রিলিক সাদা রঙের প্রলেপ দিতে হবে। তারপর এটি শুকানোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপেলটি পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে আপেল টিকে নিচের দিক থেকে লাল রং করতে হবে। তারপর লাল রং তুলি দিয়ে আস্তে আস্তে উপরের দিকে করতে হবে ।এবার উপরের দিকে কিছুটা হলুদ রং করে ,হলুদ  রং  টি লাল রঙের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হবে ।বোঁটাটিকে খয়রি রং করতে হবে। মাটির আপেল রং করার কাজ শেষ।

   কলা: কলা টি রং করার জন্য অ্যাক্রিলিক সাদা, সবুজ, হলুদ, কালো রং লাগবে ।আপেলের মত কলা টিতেও প্রথমে সাদা রং করতে হবে । তারপরেই সাদা রং টি শুকিয়ে গেলে কলা টিতে হলুদ ও কিছুটা অংশে সবুজ করবো আমরা। এবং  বোটাটির রং হবে গাঢ় সবুজ।

    *মৃৎশিল্পের গায়ের রঙের এই প্রলেপ মৃৎশিল্পকে যেমন রঙিন করে তুলে তেমন মসৃণও করে বটে*

 

 

 মাটির তৈরী আটপেল, কলা কি কি কাজে লাগবে:

 

    ক .ঘরের সাজসজ্জা: ঘর সাজাতে আমরা বিভিন্ন জিনিস কিনে থাকি। কম খরচে মাটি দিয়ে ঘর সাজাতে চাইলে বসার ঘরে, টেবিলের পাশে ,শোবার ঘর বা খাবার টেবিলে  মাটির তৈরি আপেল, কলা শোপিস হিসেবে রাখতে পারেন ।কেউ চাইলে ঘরের সাজে ভিন্নতা আনতে সামর্থ্য অনুযায়ী মাটির ফলক ,টেরাকোটা ,ফুলদানি, পুতুল ,ঝাড়বাতি ব্যবহার করতে পারেন। এতে খুব সহজেই অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে ও আপনার রুচিবোধ প্রশংসিত হবে। বাংলাদেশের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিল্পকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইসমাত জাহান মাটির জিনিস দিয়ে ঘর সাজানো বিষয়ে বলেন, সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রুচিবোধ। এরপর যার যার আর্থিক সামর্থ্য। তবে যেকোনো শ্রেণী-পেশার মানুষ মাটির জিনিস দিয়ে ঘর সাজাতে পারেন।

আরো পড়ুনঃ  

   খ.সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ : আমরা অনেকেই আছি যারা আমাদের নিজেদের মধ্যে থাকা গুণগুলোকে গুটিয়ে রাখতে চাই।  কিন্তু শিল্পচর্চা আমাদের মধ্যে থাকা শিল্প মনকে প্রস্ফুটিত করবে। হতে পারে ,এই সৃজনশীলতার চর্চা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে যেতে সাহায্য করবে। ভেবে দেখুন! সৃজনশীলতা চর্চা করার মাধ্যমে আমরা শিল্প মনের পরিচয় দিতে পারি।

 

   গ.বিক্রি করা: আমরা এই মাটি দিয়ে তৈরি আপেল ও কলা বিক্রিযোগ্য করে তুলে ,তা আমরা বিক্রি করতে পারি ।এক একটি আপেলের দাম 40-50 টাকা থেকে শুরু করে 100 টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে তা ক্রেতাদের রুচি, গুনগতমান, পরিবেশ ভেদে ভিন্ন হবে। বাজার, মেলা ,ফুটপাতসহ অনেক জায়গায় এগুলো বিক্রি করা যাবে। মৃৎশিল্প এখন শুধু দেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা সহ অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বেশিরভাগ সময়  প্রবাসী বাঙালিরা স্বজনদের মাধ্যমে জিনিস কিনে থাকেন  ।কেউ কেউ বিশেষ দিনে উপহার হিসেবে এসব পণ্য কিনে থাকেন।

 

    ঘ.পরিবেশবান্ধব কাজে লাগা : মৃৎশিল্পের আগের সেই সমৃদ্ধি এখন আর নেই। বাড়ছে বিকল্প জিনিসের চাহিদা। মাটির তৈরি তৈজসপত্র কে যুগোপযোগী করে তুলতে, পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে পরিবেশের উপর প্লাস্টিকের যে বিরূপ প্রভাব তা অনেকটাই কমানো সম্ভব ।মাটির তৈরি জিনিস গুলো ব্যবহারের ফলে প্লাস্টিকের   ব্যবহার অনেকটাই কমবে। এভাবেই আমরা আমাদের পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারব।

 

     ঙ.প্রাচীন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা: মৃৎ শিল্পের ইতিহাস আছে । ঐতিহ্য আছে ।কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্পের চিরায়ত ঐতিহ্য। কুমারদের জীবনে এখন রীতিমত চলছে ভাঙ্গনের খেলা। বিকল্প জিনিসের চাহিদা বাড়ার ফলে, কাঁচ ,প্লাস্টিক, মেলামাইনের ভিড়ে তৈরি এই জিনিসপত্রগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এখন মাটির জিনিসের চাহিদা কমে যাচ্ছে । কিন্তু এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে ধরে রাখা আমাদের কর্তব্য । এই শিল্প চর্চার মাধ্যমে একটু হলেও প্রাচীন ঐতিহ্যকে  বিলিনের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।

 

 

   মৃৎশিল্প চর্চা করার মাধ্যমে আমরা যেমন আমাদের পুরনো ঐতিহ্যের গরিমা কে টিকিয়ে রাখতে পারব, তেমনি নিজেদের টাকা পয়সা রোজগারের পথটুকুও প্রশস্ত করতে পারবো । সামান্য মাটিকে শনাক্ত যোগ্য পূর্ণাঙ্গ অবয়বে পরিণত করার মাধ্যমে যে সৃষ্টিশীলতা তা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। কিন্তু সৃষ্টির অন্তর্গত আনন্দটুকু শুধু সৃজনকারীই টের পায় । তাই সুন্দর জিনিস  কিনতে সব সময় বাজারে গিয়ে টাকা পয়সা খরচ করতে হবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। চলার পথে চোখ-কান খোলা রাখলেই আর নিজের রুচিবোধ থাকলে এসব জিনিস নিজেদের হাতের কাছেই পাওয়া সম্ভব। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. এই বিষয়টি পুরোপুরি নতুন। আগে জানতাম না।ধন্যবাদ আপনাকে। আর এইভাবে ব্যবসা করা যেতে পারে তা চিন্তাই আসে নি কোন দিন।

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক সুন্দর হয়েছে। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুন ❤️

    উত্তরমুছুন