একজন মানুষের জন্মের পর থেকে বয়সের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম
করতে হয়। সেই ধাপের মধ্যে বয়ঃসন্ধি কাল অন্যতম। কেননা ঐ সময় মানুষ নিজে একটু আলাদা
ভাবে নিজের সাথে পরিচিত হয়। কেন এমনটি হয় যদি প্রশ্ন আসে তাহলে একটা কথায় বলতে হয়-
শিশুর নানা দিক থেকে পরিবর্তন এবং বিশেষ করে শারীরিক। একটি শিশুর বড় হওয়ার কালকে
বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এটা শৈশবের শেষ এবং যৌবনের শুরু। এ সময় অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরদের মাঝে
কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।বয়ঃসন্ধিতে নানা অবস্থা
যেমনঃ
১. শারীরিক পরিবর্তন।
২. আচরণগত পরিবর্তন।
৩. মানসিক পরিবর্তন।
বয়ঃসন্ধিকাল প্রতিটি মানুষের জন্য নতুন অভিজ্ঞতার সমাহার। সাধারণভাবে বয়ঃসন্ধিকাল ৯ বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় ব্যক্তি বিশেষে বয়ঃসন্ধিকাল ২৪ বছর পর্যন্তও হতে পারে।
লেস্টেন্ট চাইল্ড এন্ড এডোলেস্টেন্ট হেল্থ জার্নালে এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের একটি লেখা প্রকাশ করেন। কেন মানুষের এই বয়ঃসন্ধিকালের মেয়াদ বৃদ্ধি পাচ্ছে? তার বিভিন্ন কারণ বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে বের করেছেন। সেটা যেহেতু আমাদের মূল আলোচনার বিষয় নয় তাই আবার টপিকেই ফিরে যাই।
বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক পরিবর্তন
এ সময় ভুল করার প্রবণতাও খুব বেশি। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েরা এমন কিছু কাজ করে বসে যা মা-বাবার চিন্তার বাহিরে। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা। মা-বাবার অলক্ষ্যে তাদের টাকা পয়সা নেয়া। বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা, আড্ডা, যা মন চায় তাই করা এবং তারা মনে করতে থাকে আমিই সর্বেসর্বা ইত্যাদি।
ঠিক এই সময়টিতেই অভিভাবকের সবচেয়ে বেশী সচেতন থাকতে হবে। সন্তানের সবচেয়ে আপন ও কাছের বন্ধুটি যেন তার মা-বাবাই হয়ে ওঠেন। কিভাবে মা-বাবা তার সন্তানের নির্ভরযোগ্য এবং ভরসাযোগ্য বন্ধু হবেন তার সিদ্ধান্ত কিন্তু তাদেরই নিতে হবে।
যৌন বিষয়গুলোতে তাদের আকর্ষণ থাকে বেশী। যে কারনে অনেক ছেলে মেয়ে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের সাথে অনেকে আবার নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে। এই সময়টাতে কিশোররা নিজেদের বড় ভাবতে শুরু করে।
যৌন শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের দেশের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। অনেকে বুঝেই না তার পরিবর্তনটা। যে কারণে সে মানসিক দিক থেকে হীনমন্যতায় ভোগে। কাওকে কিছু শেয়ার করতে পারে না আবার নিজের পরিবর্তনকে অস্বাবাবিক বলেও বাবতে তাকে।
অনেকে আবার নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। মানুষকে এভয়েড করে নিজে নিজে একাকী থাকতে চায়। তাদের মন যে কখন কি চায় তা সে নিজেও জানে না।
কোন কাজে
চেলে-মেয়েদের বাধা দিলে তারা রেগে যায়। মতের বিঘ্ন ঘটলেই অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু
করে।
আর এই অবস্থার মধ্যে যদি তাকে কেউ শাসন করে তাহলেতো মৃত্যু ঝুকি আছে এমন কাজও করে বসে ছেলে-মেয়েরা।
অনেকে আছে যারা কারও সামনে যেতে লজ্জা পায়। মানসিকভাবে সে প্রস্তুত থাকে না কারও সামনে যেতে।
মোটামুটি এই পরিবর্তনগুলো দেখা যায় বয়ঃসন্ধিকালীন সময়টিতে। আর এই সময় যদি তাদের বুঝানো হতো যে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই তোমরা এমন বোধ করছ। মানসিক যে অস্বস্তি বোধ কর তা একেবারেই স্বভাবিক।
তাহলে হয়ত
আমাদের ছেলে-মেয়েরা অনেক ভাল ও সুস্থ্য জীবন-যাপন করতে পারতো।
২. আচরণগত পরিবর্তন
বয়ঃসন্ধিকালে একজন কিশোর কিশোরীকে আশেপাশের আত্মীয়, পরিচিত- অপরিচিত মানুষজন বড় ভাবতে শুরু করে। আবার বড়দের মতো আচরণ করলেও পাকামো মনে করে। এই সময়টাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিপত্তি বলে সম্বোধন করেন। ছুটি গল্পেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। ফটিকের আচরণিক পরিবর্তনই আমরা চোখে দেখি কিন্তু দেখি না তার হৃদয়ের কান্না। তার মুক্তির বাসানাগুলো নিষ্পেষিত হয় বারবার। অভিভাবকের অসচেতনতায় ঝরে যায় প্রাণ।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরীদের নানা আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তারা নানা প্রকার ভুল করে এ সময়। অবাধ্যতার বিষয় ব্যাপক হারে লক্ষ্য করা যায়। নেতিবাচক বিষয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। নিজেকে জানান দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। নিজেকে বড়দের সমকক্ষ ভাবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
বয়ঃসন্ধিকালে মা বাবা বা অভিভাবকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করতে হবে। কিশোর কিশোরীদের এই সময় দ্বান্দ্বিকতার প্রভাব বেশি দেখা যায়। এই
সময় মা বাবার সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তাদের
মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ
৩ শারীরিক পরিবর্তন
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরীদের নানা প্রকার শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কিশোরদের পরিবর্তন একরকম এবং কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন অন্যরকম হয়।
ছেলেদের শারীরিক পরিবর্তন
ইউনিসেফ এর মতে ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকাল ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে হয়ে থাকে।
- এ সময় ছেলেদের দেহের উচ্চতা দ্রুত বাড়তে থাকে।
- গলার স্বর ভারী হয়ে আসে।
- কাঁধ চওড়া হয় এবং পেশী সুগঠিত হয়।
- মুখে দাড়িঁ, গোফ ওঠে।
- শরীরের নানা জায়গায় বিশেষ করে বুকে, বাহুবলে ও যৌনাঙ্গের পাশে লোম গজায়।
- অনেক সময় ছেলেরা এ সময়টিতে একটু বেশি ঘামে।
- অনেক সময় ঘুমের মধ্যে ছেলেদের বীর্যপাত হয়ে থাকে। যা স্বাভাবিক একটা ঘটনা।
- এককথায় বলতে হয় বয়ঃসন্ধির সময় ছেলেরা নতুন একজনকে পায় যে শিশু থেকে বড় হচ্ছে। তাই এই পরিবর্তন এর সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নেওয়া একটা বড় চ্যালেন্জ।
মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনঃ
বয়ঃসন্ধির সময় মেয়েদের শারীরিক বিকাশ খুব দ্রুত ঘটে।
মেয়েদের দৈহিক উচ্চতা বাড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত এটি ১৬-১৭ বছর পর্যন্ত স্থায়ী
হয়।
মেয়েদের দৈহিক আকার আয়তন বৃদ্ধি পায়। ওজন বৃদ্ধি পায়।
তাদের ডিম্বাশয় চওড়া হতে পারে। মেয়েদের উরু এবং পেটে মেদ জমে।
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের স্তনের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।
যোনি পিঠে ও বাহুমূলে লোম ওঠে।
মেয়েদের ঋতু চক্র আরম্ভ হয়। তলপেটে ব্যথা হতে পারে।
শারীরিকভাবে দুর্বলতা অনুভূত হয়। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে মুখে ব্রণ সমস্যা দেখা দেয়।
পড়ুনঃ
বয়ঃসন্ধিকালে মা বাবার ভূমিকা
এই সময় কিশোর কিশোরীদের শরীর নানা প্রকার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। বয়সন্ধিকালে তাদের এ পরিবর্তন স্বাভাবিক। এ সময় তাদের শরীরে প্রোটিনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ভাই তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত মাছ মাংস ডিম দুধ এবং প্রচুর ফলমূল খেতে দিতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে শরীরের গঠন বৃদ্ধি পায়। হাত পা দ্রুত বড় হতে থাকে।
এ সময় যেন তাদের পর্যাপ্ত ঘুম হয় সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের বলতে হবে ঘুমের মধ্যে শরীর সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। তাদের বোঝাতে হবে এ সময় পর্যাপ্ত খাবার ও পর্যাপ্ত ঘুম শরীর বৃদ্ধিতে সহায়ক। ঘুমের সময় গ্রোথ হরমোন সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এ সময় অনেক বেশি গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়। উল্লেখ্য যে বয়ঃসন্ধিকালের পরবর্তী সময় কিন্তু শরীর আর ততটা বৃদ্ধি পায় না।
তাদের বোঝানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক অবস্থা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত থাকে। তাদের বোঝানোর মত করে বোঝাতে হবে। ধমকের সুরে নয় তার মতো হয়ে তাকে বোঝাতে হবে।
1 মন্তব্যসমূহ
আপনার প্রতিটা পোস্ট অনেক তথ্য বহুল।
উত্তরমুছুন