রমজানের স্বাস্থ্যকর খাবার কেমন হওয়া উচিৎ তা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি ও অসুস্থ মানুষ ছাড়া তেমন কারও জানার আগ্রহ খুব একটা নাও থাকতে পারে। কিন্তু রমজান মাসে স্বাস্থ্য সচেতনতা সকলের জন্য আবশ্যক।
রমজানে আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রায় বেশ কিছুটা পরিবর্তন আসে। সারাদিন না খেয়ে সন্ধ্যায় ইফতার এবং রাতে তারাবী পরে আবার দুইবার খাওয়া-দাওয়া করা। তারপর আবার সেহেরি খেতে অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠতে হয়।
তার
মানে দৈনন্দিন জীমনযাত্রায় যে পরিবর্তন দেখা দেয় তার সাথে নিজের কাজ এবং শরীরকে
খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য ভিন্ন প্রস্তুতি দরকার। এই পরিবর্তন এর ফলে অনেকেই আবার
অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারণ অনেক বেশী খেয়ে ফেলা এবং তেলে ভাজা খাবার খাওয়া যার অন্যতম
কারণ।
তাই কিভবে আমাদের খাওয়া উচিৎ এবং কিভাবে
খেলে অসুস্থ হব না তা আমাদের জানা উচিৎ নয় কি? সাধারণত রমজানে খাবার এর
কারণেই অধিকাংশ মানুষ অসুস্থ হয়ে থাকে। তাই কখন কি খাওয়া উচিৎ এবং কিভাবে খাওয়া
উচিৎ তা নিয়েই আলোচনা করতে যাচ্ছি।
রমজানের স্বাস্থ্যকর খাবারঃ ইফতার
সারাদিন না খেয়ে থেকে আমরা ইফতারে যখন খাবার
খাই তখন যেন বেহুশ হওয়ার মত অবস্থা। কি রেখে কি খাব ঠিক নাই।
রমজানের ইফতারে ভাজপুড়া খাব না তাতো হতে
পারে না। তাই আমি বা ডাক্তার মশাই যে যতই বলুক ভাজাপুড়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
আসলে কেউ তা খাওয়া বন্ধ করবে না। তাই কথা হলো ভাজাপুরা খাও কিন্তু পরিমানে অল্প
করে খাও।
তেলে ভাজা বেগুনী,চপ,
পেয়াজু, বড়া, ইত্যাদি
ঠিক যতটা খেতে সুস্বাদু ঠিক ততটাই আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই এড়িয়ে চলা
সবচেয়ে ভাল। ভাজাপুড়ি খেলে বুকজালা-পুড়া, হজমে সমস্যা,
গ্যাসফল, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি নানা
সমস্যা হতে পারে।
আরে ভাজাভুজি না খেয়ে তাহলে কি খাব?
খুব ভাল প্রশ্ন যে তাহলে কি খাব। হ্যাঁ, তাহলে
চলুন এখন বর্ণনা করছি আসলে রমজান মাসে কিভাবে আমাদের ইফতার করা উচিৎ এবং কি কি
খাওয়া উচিৎ।
রমজান প্রতিটি মুসলমানের জন্য অন্যতম মাস
কারণ এই মাসে নিজেকে সংযম, আত্নশুদ্ধি, নিয়মশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় শিক্ষা দেয়। আর মুসলমান হিসেব নিজেকে সঠিক পথে
চলাতে চাইলে সুন্নতের কোন বিকল্প নেই।
আর ইফতারের শুরু হোক সুন্নত দিয়ে। নবীর
অন্যতম সুন্নত খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা। আসলে খেজুরে রয়েছে পটাসিয়াম এবং ফাইবার
যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল। আর খেজুর ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার গুলোর মধ্যে
অন্যতম। তাই একই সাথে আপনি সুন্নত পালন করছেন এবং সেই সাথে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে
নিজেকে রাখছেন সুস্থ্য।
এরপর অনেকেই ঢক ঢক করে গ্লাসের পর গ্লাস
পানি পান করে নেয়। কিন্তু তা মোটেই উচিৎ নয়। বেশী পানি পান করে নিলে আপনি যে খাবার
খাবেন তা পাকস্থলিতে ভেসে যাবে। তাছাড়া বেশী পানি পান করার পর দেখবেন আর অন্য কিছু
খেতেও পারছেন না। তাই অল্প অল্প করে পানি পান করতে হবে।
এখানে আবার কথা আছে গরমের কারণে খুব মজা করে
ফ্রিজের পানি পান করে থাকেন অনেকে।
ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করা কতটা ক্ষতিকর ? একবার জানুন আগে।
১. হঠাৎ করে ঠান্ডা পানি পান করায় শরীরে
ভেতরে রক্তনালীগুলো সংকুচিত হতে পারে। এতে করে হার্টের সবচেয়ে ক্ষতি হয়।
২. জ্বর হতে পারে- সাধারণত মানুষের দেহের
তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। কিন্তু যখন কেউ হঠাৎ ফ্রিজের পানি পান করে
তখন রক্ত হঠাৎ করেই শীতল হয়ে যায়। আর এই কারণে জ্বর উঠে যায়।
৩. খাদ্যনালী সংকুচিত করে ঠান্ডা পানি পান
করলে।
৪.টনসিল ফুলে যেতে পারে এবং তা থেকে ক্ষতের
সৃষ্টি হতে পারে।
৫. যাদের মাইগ্রেন এর সমস্যা রয়েছে তাদের
মাইগ্রেন এর ব্যাথা বাড়তে পারে।
এছাড়াও নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে ঠান্ডা
পানি পান করার ফলে। তাই সারাদিন রোজা রেখে যখন হঠাৎ করেই ঠান্ডা পানি পান করা হয়
তখন স্বাভাবিক ভাবেই শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন দেখা দেয়। আর উপরে উল্লেখিত
সমস্যাগুলো আরও মারাত্মকভাবে দেখা দিতে পারে।
এরপর অনেকেই বিভিন্ন ফল দিয়ে খাওয়া শুরু
করেন। অনেকের ধারণা যে খালি পেটে ফল খেলে এসিডিটি হয়ে থাকে। কিন্তু তা আসলে সত্য
নয়। আপনি তাই ফল দিয়ে খাবার শুরু করতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ
এরপর আপনি অল্প পরিমানে মুড়ি-বুট-বড়া খেয়ে
নিন। কিন্তু বিশেষভাবে আবার বলছি ভাজাপুড়া মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সাধারণত দুইটি
পেয়াজু,
একটি আলুর চপ, দুটি বেগুনী, অল্প কিছু ছোলা এবং প্রয়োজনমত মুড়ি নিয়েই শেষ করুন ভাজাভুজির অধ্যায়।
এখন আসা যাক শরবত এর কথায়। আপনি সারাদিন
রোজা রেখে নিশচিন্ত মনে বিভিন্ন ফলের জুস খেতে পারেন। তরমুজ, ডাবের
পানি, আনারস ইত্যাদির জুস করে খেতে পারেন। আর এই ফলের জুস
গুলো আপনার পানির অভাবদূর করে আপনার ক্লান্তিভাব দূর করবে। তাছাড়াও লেবু, বেল, মাল্টার জুস খেতে পারেন। তবে কথা থাকে যে
বেশী করে চিনি দিয়ে এই শরবত খাওয়া ঠিক হবে না।
চিনি আমাদের শরীরে জন্য এমনেতেই ক্ষতিকর।
কিন্তু চিনি না দিলেতো ভাই মজাই হয় না। তাহলে কি করা যেতে পারে। চিনির বিকল্প
হিসেবে আপনি বেছে নিতে পারেন গুড়কে। আবার
একবারে চিনি না খাওয়াও আমাদের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে উচিৎ নয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে একজন সুস্থ পুরুষ
মানুষ দিনে আট চা চামচ চিনি খেরেত পারেন আবার একজন নারী সারাদিনে ছয় চা চামচ চিনি
খেতে পারেন। তাই আপনি পরিমাণমত চিনি খেতেই পারেন। তবে মনে রাখতে হবে যদি আপনার
ডায়বেটিস থাকে তাহলে তা পুরোপুরি এ্যাভয়েড করতে হবে।
তবে অনেকের পছন্দ দই এবং চিড়া মিক্সড। দইয়ে
পটাসিয়াম এবং সোডিয়াম কম থাকে যা সহজে হজম হয়। তাছাড়া চিড়া পেটকে ঠান্ডা করে।
এছাড়া দইয়ে থাকে প্রোবায়োটিক যা অন্ত্রে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। তাই
ইফতারে খাবার হিসেবে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে খেতে পারেন দই চিড়া।
খেতে পারেন নরম খিচুড়ি। একে অনেকে বলেন সবজি
খিচুড়ি। সবজি খিচুড়ির সাথে কুচি কুচি করে নানা প্রকারের সবজি, অল্প
মাংস কুচি, এবং পানির পরিমাণ কিছুটা বেশী দিয়ে খুব নরম
করে তৈরী করতে হবে সবজি খিচুড়ি। এই খিচুড়ি অন্তত ছোলা-মুড়ির চেয়ে ভাল। তাই ইফতারে
খেতে পারেন সবজি খিচুড়ি।
রমজানের স্বাস্থ্যকর খাবারঃ রাতের খাবার
রাতের খাবারে খুব অল্প খাওয়ায় ভাল। সাধারণত
আমরা ইফতারে বেশী খেয়ে থাকি। তাই রাতের বেলা এমনিতেই খুব বেশী খেতে ইচ্ছে করে না।
যে কারণে অনেকেই আছেন একেবারেই খেতে চান না। একেবারে সেহেরি খায়। কিন্তু এই কাজটি
একেবারেই ঠিক না। অল্প পরিমাণ খাওয়া ভাল। তবে রাতের খাবার খেতে হবে যকদ্রুত সম্ভব।
অনেকে আছেন তারাবী পড়ার আগেই খেয়ে নেন আবার
অনেকে আছেন তারাবী পড়ার পরে খান। এই বিষয়টি নির্ভর করে আপনার কমফোর্ট এর উপর। তবে
তারাবী পড়ার আগে খেতে পারলে তা হজম হওয়ার চান্স থাকে। কিন্তু যদি অতিরিক্ত পরিমাণ
খাবার খাওয়া হয় ইফতারে তাহলে তা আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই সম্ভব হলে তারাবীর
আগেই খাওয়া-দাওয়া করে নেয়া উচিৎ।
রাতের খাবারে খুব হালকা খাবার খাওয়া ভাল।
মসলা ও তেল জাতীয় খাবার পরিহার করা উচিৎ। অল্প ভাত, ডাল বা মাছ এর তরকারী
খেতে পারেন। পাতলা ডালও খেতে পারেন। রাতের খাবার পরিমানে অল্প খাওয়ায় ভাল।
রমজানের স্বাস্থ্যকর খাবারঃ সেহেরী
সেহেরীতে কি খাবেন? বেশী
না কি কম? মাছ, মাংস নাকি
শাক-সবজি? হালকা নাকি ভারী? আসলে
সেহেরীতেও হালকা খাবার খাওয়ায় ভাল। বেশী খেলে সারাদিন বুক জ্বালাপুড়া করা, বাজে ঢেকুর আসা, পেট ফেঁপে যাওয়া, পেট বুটবুট করাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই সেহেরিতে অল্প
পরিমাণ খেতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় ভাত ও সবজি খাওয়া। তারপরও অনেকেই মাছ ,মাংস খেয়ে থাকেন। যা পরিমানে অল্প খাওয়ায় ভাল।
এমন খাবার খেতে হবে যা পেটে আরাম দেয়, ঠান্ডা রাখে। আবার অনেকে প্রচুর পানি পান করে থাকেন সেহেরিতে। এটা মোটেও ঠিক নয়। বেশী পানি পান করলে যে পানির ঘার্তি পূরণ হবে তা কিন্তু মোটেই না।
বরং বেশী পানি পান করলে প্রস্রাব এর
বেগ বৃদ্ধি পাবে। মূল কথা অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না। তাই সেহেরীতে হোক কিংবা
ইফতারে পরিমাণমত খাওয়ায় ভাল। আর খাবারের পরিমাণ নিজেই ঠিক করতে হবে। কতটুকু খেলে
আমার সমস্যা হবে না এবং কতটুকু খাওয়া উচিৎ তা নিজেকেই বুঝতে হবে।
রমজানে চা- কফি বাদ দেয়াই ভাল। কেননা
ক্যাফেইন আমাদের পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে এবং মুত্র এর চাপ বৃদ্ধি করে।
রমজান হচ্ছে ধূমপায়ীদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। যে কোন ধূমপায়ী চাইলেই এই
একমাসে ধূমপান ছেড়ে দিতে পারেন।
যেহেতু পানি পিপাসা বৃদ্ধি পায় সেহেতু খুব
অল্প অল্প করে পানি পান করতে হবে। ইফতারের পরে একটু একটু করে পানি পান করতে হবে।
একসাথে বেশী করে পানি পান মোটেই উচিৎ নয়।
অনেকেই একটু পেটের সমস্যা দেখা দিলেই
গ্যাসট্রিক এর ট্যাবলেট খেতে শুরু করে । যা মোটেই ঠিক না। ট্যাবলেই খেলে ডাক্তার
এর পরামর্শে খাওয়া উচিৎ। তবে ট্যাবলেট খেলে টানা খাওয়ায় ভাল। যখন মন চায় বা যখন
সমস্যা হয় তখন খেলাম অন্য সময় খেলাম না এরকম মোটেই উচিৎ নয়।
সবশেষ কথা হলো কি খাবার খেলে আপনি ভাল
থাকবেন তা কম বেশী আমরা সবাই জানি। কিন্তু রমজান উপলক্ষ্যে আমাদের মাঝে যে আমেজ
কাজ করে তার কারণেই আমরা অনেক বেশী খাওয়া দাওয়া করি। তাই অবশ্যই আমরা রমজানে
স্পেশাল খাবার খাব কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।
0 মন্তব্যসমূহ
please don't enter any spam links in the Comment Box.